ঢাকা,শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

‘অর্থের মোহে আদর্শচ্যুতি’।। ছাত্রলীগ : নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ

BSLঋত্বিক নয়ন ::: বিপরীত মতাদর্শের সংগঠন নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ। চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতার অনুসারীদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত ওপেন সিক্রেট। পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তার, ভাগবাটোয়ারা এবং প্রতিপক্ষ গ্রুপের কাছে হিরোইজম প্রকাশের মাধ্যমে নিজেকে নেতার কাছে জাহির করার প্রবণতা ছাত্রলীগের মধ্যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গ্রুপ উপগ্রুপের জন্ম দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে অনেকটাই হতাশ ছাত্রলীগের ত্যাগী নেতাদের অনেকেই। তাদের মতেআদর্শের চেয়ে অর্থের গুরুত্ব যখন বেড়ে যায়, তখন এধরনের করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। অন্যদিকে নগর ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ এ ধরনের কোন্দলে জড়িতদের ছাত্রলীগ বলে মানতে নারাজ। নেতৃবৃন্দ যেভাবেই ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করুন না কেন, আওয়ামী রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নগরীর বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কর্মকান্ড ভবিষ্যতে দলের জন্য অশনি সংকেত বলেই মন্তব্য করেছেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান তারেক নিঃসংকোচে স্বীকার করলেন, রাজনীতি এখন ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের হাতের মুঠোয়। ছাত্রলীগের মূল আদর্শ মানতে যাদের অনীহা, তারাই এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটিয়ে ছাত্রলীগকেই বিতর্কের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আদর্শ মানলে তো আমার নেতা হবেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর যদি কেউ থাকেন তবে তিনি জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটাই গ্রুপ থাকার কথা। কিন্তু এখন যত নেতা, তত গ্রুপ। এটা কেন হবে? এটা হচ্ছে কারণ ছাত্রলীগে যারা আসছে, তারা লাভের জন্য আসছে। আখের গুছাতে সহকর্মীকে প্রতিপক্ষ ভেবে পথ থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। এরা আসলেই কি ছাত্রলীগ নাকি অন্যকিছু, এ বিষয়টি আমার কাছেই পরিষ্কার নয়। তিনি বলেন, ক’দিন আগে দেখলাম খাওয়ার বিল নিয়ে ঝামেলায় প্রবর্ত্তক ও চকবাজারে হোটেল ভাঙচুর করেছে। অথচ আমরা যখন রাজনীতি করতাম , তখন মাত্র দশ টাকায় ডাল ভাত পেঁয়াজু খেয়ে কখনো খালি পেটে সংগঠনকে প্রসারিত করতে কাজ করতাম। পকেটে খাওয়ার পয়সা না থাকলে ঢুকবো না। কিন্তু খেয়ে বিল না দিয়ে ছাত্রলীগ পরিচয় দিয়ে বের হয়ে আসবো, এ ধরনের কর্মকান্ডে মেধাবীরা ছাত্রলীগে আসতে চাইবে না। আমি মনে করি এরা সব সুদিনের পাখি। দলের বিপর্যয়ে তারা ভোল পালটে অন্য কোন দলে ভিড়বে।

তবে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম রনি, সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের নাম পরিচয় ব্যবহার করে বিতর্কিত কর্মকান্ডের দায় সংগঠনের উপর দিতে নারাজ। আজাদীকে তিনি বলেন, সিলেট, রাজশাহী কিংবা ঢাকায় সংঘর্ষ বলতে যা বুঝায়, তেমন কিছু চট্টগ্রামে হয়নি এখনো। যে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, তার কোনটিই ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের কাজ নয়। হয় সাবেক ছাত্রলীগ অথবা বহিকৃত ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরাই এ ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। ছাত্রলীগের কর্মকান্ড হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক। এখন সে রিয়াজউদ্দিন বাজার কী করছে কিংবা সিআরবিতে কেন গিয়েছে তার দায়তো সংগঠনের হতে পারে না। তিনি উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেনশনিবার রিয়াজউদ্দিন বাজারে নিহত ইয়াছিনের মা থানায় যে মামলা করেছেন, তাতে কারণ হিসেবে মোটর সাইকেল চুরির ঘটনা উল্লেখ করেছেন। একজন কর্মী হয়তো এক দু’ঘন্টা ছাত্রলীগকে সময় দিচ্ছে। এটা ছাড়াও তার ব্যক্তিগত জীবন আছে, সামাজিক জীবন আছে। সেই জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য ছাত্রলীগ কেন দায়ি হবে? তিনি বলেন, আগ্রাবাদে এক কাউন্সিলরের অনুসারিদের সাথে বহিকৃত এক ছাত্রলীগ কর্মীর অনুসারিদের সংঘর্ষ হয়েছে। অথচ পত্রিকায় লেখা হলো ছাত্রলীগের দুগ্রুপের সংঘর্ষ। ঘটনায় জড়িতদের কেউই ছাত্রলীগের কোন পর্যায়ের সদস্য নন।

তবে নেতৃবৃন্দ যে ভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, সর্বশেষ গত ১১ ফেব্রুয়ারি শনিবার রিয়াজউদ্দিন বাজারে ইয়াছিন আরাফাত খুনের ঘটনায় নিহত ব্যক্তি এবং মামলার প্রধান আসামী হারুনুর রশিদ, দুজনই ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। ইয়াছিন ও হারুন উভয়ই নগর ছাত্রলীগের উপ গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল আহাদের অনুসারী। সম্প্রতি আহাদের পক্ষ ত্যাগ করেন ইয়াছিন। এরপর থেকেই মূলত ইয়াছিনের অনুসারীরা এবং আহাদের অনুসারী হারুনের ছেলেরা পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান নেয়। রিয়াজউদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক আরও বিভিন্ন ধরনের অবৈধ কর্মকান্ড নিয়েও গ্রুপের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। ইয়াছিন খুনের দিনই কথা কাটাকাটি জেরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষে অন্তত ৮ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাহজালাল হলের ৮ থেকে ১০টি কক্ষ ভাংচুর হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সংঘর্ষে লিপ্ত ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ সিক্সটি নাইন ও ভিএক্স নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর বাকলিয়ায় স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা তানজিরুলকে গুলি করে প্রতিপক্ষের কর্মীরা। রাত এগারটার দিকে হাজী আমিনুর রহমান রোডে আড্ডা দিচ্ছিল তানজীরুল ও তার কয়েকজন বন্ধু। এ সময় নন্দন কাননের যুবলীগ ক্যাডার অমিত মুহুরীসহ তার অনুসারী আরো কয়েকজনকে নিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের অন্য গ্রুপের নেতা জনি মোটর সাইকেল যোগে তার বাকলিয়ার বাড়িতে যাচ্ছিল। অমিত ছিল জনির মোটর সাইকেলে। তানজীরুল ও তার বন্ধুরা মহিউদ্দিন জনিকে আটকে এলাকায় অমিত মুহুরীকে নিয়ে শোডাউন দিচ্ছে কেন জানতে চায়। নেতার সামনে তানজিরুলের এ কথায় জনির আঁতে ঘা লাগে। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সে তানজীরুলের ডান উরুতে গুলি করে। গুরুতর আহত হয়ে তানজিরুল লুটিয়ে পড়ে। এসময় তানজীরুলের সঙ্গে থাকা বন্ধুরা পালিয়ে যায়। আর অমিতের সঙ্গে থাকা সবাই ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে চলে যায়। গত ২৫ জানুয়ারি সকালে নগরীর চেরাগীর মোড়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এর জের ধরে সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের একপক্ষ প্রতিপক্ষকে নিজেদের শক্তি দেখাতে গিয়ে ভাংচুর করে আশপাশের দোকানপাট ও গাড়ি। এসময় সৌন্দর্য বর্ধনের অংশ হিসেবে রাস্তার আইল্যান্ডের উপর লাগানো গাছের টবগুলোও ভাংচুর করা হয়। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ছাত্রলীগের স্থানীয় দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা চলে আসছিল। এর সূত্র ধরে বুধবার সকালে দুই পক্ষের কর্মীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি হয়। পরে পুলিশ এসে দুইজনকে ধরে নিয়ে যায়। তবে দুপুরের দিকে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। তাদের ছেড়ে দেয়ার পর একইদিন সন্ধ্যায় এক পক্ষের নেতাকর্মীরা অতর্কিত বের হয়ে আশপাশের দোকানপাট ও গাড়ি ভাংচুর করতে থাকে। এসময় তারা একটি দোকানের টাকা লুট করে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। তারা সবমিলিয়ে ছয়টি দোকান ও একটি টেম্পু ভাংচুর করে।

গত ২৩ জানুয়ারি মিরসরাই উপজেলার নিজামপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কলেজ ক্যাম্পাসে নুরুল আমিন মুহুরী (২৬) নামে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হন। গত বছরের ২০ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেট এলাকার নিজ বাসা থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক পক্ষের নেতাকর্মীরা বলছেন, দিয়াজকে হত্যা করে আত্মহত্যা হিসেবে প্রচার করার জন্য লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। গত বছর ১ নভেম্বর আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এইচএম সোহেল এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে আড়াই বছর আগে বহিষ্কৃত সাইফুল ইসলাম লিমনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একই বছরের ১৭ ও ১৮ অক্টোবর নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়ে বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম লিমন ও নগর যুবলীগ নেতা জাবেদুল আলম সুমন গ্রুপের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে আন্দরকিল্লা ও টেরিবাজার এলাকায় যানবাহন এবং দোকানপাট ভাংচুর ও লুটের ঘটনা ঘটে। গত বছর ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হয় মহানগর ছাত্রলীগ কর্মী ও এমবিএ’র ছাত্র নাসিম আহমেদ সোহেলকে। আজাদী

 

পাঠকের মতামত: